ঘেরাটোপ
বাথরুমের
দরজাটা লাগাতে গিয়েই রে রে করে
উঠলো সৌমিত - "আরে আরে এখানে
এ ছবিটা কে টাঙিয়েছে?"-"ন্যাকামো" খিঁঁচিয়ে উঠলো লিলি - "আমি
ছাড়া আর কে টাঙাবে
শুনি ?"কোনরকমে তোয়ালে জড়িয়ে হানটান করতে করতে রান্নাঘরের
দরজায় সৌমিত - "বাথরুমে মাধুরী দীক্ষিতের ছবি কেউ টাঙায়
- আশ্চর্য তোমার কী মাথাটা গেছে ?" ফুঁঁসিয়ে উঠলো লিলি - "কেন
মাধুরী কী মা দুগ্গা
যে বাথরুমে ছবি রাখা যাবে
না ? এখন কিছুদিন ছবিটা
ওখানেই থাকবে যতোদিন না পজিটিভ কোনো
খবর আসছে,ব্যস !" লিলির
মা হওয়ার
খবরের সঙ্গে মাধুরীর কী সম্পর্ক ! কেমন
ভেবলিয়ে গেল সৌমিত।বিয়ের তিন
বছর পর সন্তান নেওয়ার
সিদ্ধান্তটা ওদের যৌথ, এর
মধ্যে মাধুরী এলো কোথ্থেকে ? অফিসের
ক্যাব চলে আসবে এখনো
সিস্টেম ক্লিয়ার হয় নি, কথা
না বাড়িয়ে সৌমিত বাথরুমে দৌড়লো।লাঞ্চ বক্স নিয়ে দরজার
দিকে পা বাড়ানোর আগে
মুখ গোঁজ করে একঝলক
লিলির মুখের দিকে তাকিয়েই দরজা
টেনে দিল।পটি ক্লিয়ার না হলে আর
যাই হোক আদিখ্যেতা
আসে না।পৃথিবীর কোনো পুরুষ পারবে
ঐরকম সুচিত্রামার্কা হাসি নিয়ে মনরোর
বিভঙ্গে দাঁড়ানো মাধুরীর সামনে পটি করতে ? আরে
ছবি বলে কী ইয়ে
নাকি ? সারাদিন অফিসে গলায় কাঁটা বেঁধার
মতো খচখচ করতে থাকলো
বাথরুমে মাধুরীর ছবি।এরমধ্যে বারদুয়েক লিলির ফোন, ধরেনি সৌমিত
- আরে ঘর গুছাবে গুছাও
তার জন্য বসার ঘর -শোয়ার ঘর
-খাওয়ার ঘর -রান্না ঘর - ঘরের অভাব ? তাই বলে বাথরুম - ঠিক আছে সাজাও
বাথরুম,গাছের টব রাখো -বই
রাখো -মালের বোতল রাখো -ফুলদানি
রাখো - তা না যত্তোসব !বাড়ি ফিরে আজ
একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।
অফিস
সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে
সাড়ে আটটা হয়েই যায়।ফ্রেস
হয়ে ব্যালকনিতে দুপেগ নিয়ে বসা রোজকার
নিয়ম।আগে লিলিও টুকটাক সঙ্গ দিতো এখন
লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে হরলিক্স
নিয়ে বসে,শালা কোথায়
কী একেই বলে গাছে
না উঠতেই এক কাঁদি।এক প্লেট সল্টেড
কাজু নিয়ে লিলি এসে
বসতেই সৌমিত কথা পাড়লো - "এবার বলো তো মাধুরীর
কেসটা কী ?" - " মা বলেছে" - "মানে ?
কার মা ?'' "কার মা আবার ? আমার মা !" ঝামড়ে
উঠলো লিলি - "তোমার
মায়ের আমার বাচ্চা নিয়ে
কোন মাথাব্যথা আছে ? আজ অবধি
কোনও খোঁজ নিয়েছে ?" - "এই
দাঁড়াও দাঁড়াও দাঁড়াও - এক মিনিট।তোমার বাচ্চার
খোঁজ নিয়েছে মানে ? তোমার বাচ্চা
কই ? আরে যে বাচ্চাটা পয়দাই হলো না - যাকে
সবে আনার কথা ভাবা
হচ্ছে - তার খোঁজ নেয়
না - মানেটা কী ?" সামান্য থমকিয়ে
গলা চড়ালো লিলি - "খোঁজ
নেবে মানে এই যে,
আমরা কী ভাবছি - কবে
বাচ্চা নেবো - এখনো কেন নিচ্ছি
না - এইই।এটাই কি
কখনও জানতে চেয়েছে তোমার মা ?" এতক্ষণে পেগ দুই
চলে গেছে পেটে,লাফিয়ে
উঠলো সৌমিত - " শাল্লা বলে কী ! মা
নিজের ছেলের খবর নিলে তুমি
ডায়লগ মারো প্রিভেসিতে হাত
দিচ্ছে আর তোমার উড
বি বাচ্চার খোঁজ নিলে তো
তুমি 498 ঠুকে দেবে সোনা !
এসব ফালতু কথা ছাড়ো, মাধুরীর
কেসটা একটু খোলসা করে
বলো দেখি কী ব্যাপার।" একটু থম মেরে
লিলি বলে উঠলো - "তুমি
চাও না আমাদের মেয়ে
মাধুরীর মতো দেখতে হোক ?" - "এই তোমার কী হয়েছে বলতো
খালি আনসান বকছো ? আমাদের মেয়ে
মাধুরীর মতো দেখতে হবে
কেন ? মানে কী করে ? আমার নাক দেখেছো
ডানা মেলা প্রজাপতির মতো,মাইলস্টোনের মতো
দাঁত,চোখ যা হোক
চশমা দিয়ে ম্যানেজ হয়ে
যায় - নেহাত মোটা মাইনেয় তোমাকে
ম্যানেজ করা গেছে - তুমি
একলা আর কতো ড্যামেজ
কন্ট্রোল করবে সুন্দরী ?" এবার
একটু নরম হয়ে এলো
লিলি - " তাই তো মাধুরীর
হেল্প নিচ্ছি গো।মা বলেছে এটা অত্যন্ত গোপন
তুক ! দেখো না
আমার বাবাকে,দেখতে তোমার মতো অতোটা ইয়ে
না হলেও - দেখতে তো ইয়েই বলো ? অথচ আমরা দু'বোন দেখতে কেমন
হয়েছি বলো ? কেউ বলবে
ঐ বাবার মেয়ে ? সব ঐ মায়ের
তুকের জোরেই তো ! লাস্ট পিরিয়ডের
পাঁচদিনের মাথায় স্নান করে যার মুখ
দেখবে বাচ্চা ঠিক তার মতো
দেখতে হবে - তাই
তো মাধুরী ! ওরকম টোনড বডি
- টোল পড়া গালে সুচিত্রার
হাসি - প্লিজ ছবিটা তুমি সরাতে বোলোনা।
কোন মাসে লেগে যায়
কেউ বলতে পারে ? একবার
প্রেগানিউজ গ্রিন সিগন্যাল দিলেই ও ছবি আমি
সরিয়ে দেব,পাক্কা !" - " যাচ্চলে
এই কথা ? তা তুমি
যখন চান করো বাড়িতে
তো কেউ থাকে না
বাড়িতো ফাঁকা, ছবিটা অন্য কোথাও রাখো
বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলেই
তো হলো।বাথরুম থেকে সরাও প্লিজ,তুমি পারবে বলো শাহরুখের সামনে পটি
করতে ?" এবার মোক্ষম চাল
চেলেছে সৌমিত, শেষ পর্যন্ত বাথরুমের
মুখোমুখি ঘরের দরজার উপর
মাধুরী থাকবে ঠিক হলো আর
যতোদিন লিলির রিপোর্ট পজিটিভ
না হচ্ছে কোন কারণে সৌমিত
বাড়িতে থাকলে পিরিয়ডের ফাইনাল দিনে লিলি স্নান
ঘরে ঢুকলে সৌমিতের ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢোকা
কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
আজ
অফিস থেকে ফেরার পথে
বহুদিন পর সৌমিত দমদম
গেলো মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।লিলির সুসংবাদ
টাও দিয়ে আসা যাবে।মাস
দুয়েক হলো লিলির প্রেগনেন্সি
কনফার্মড হয়েছে।রাতের খাওয়া মায়ের কাছে সেরে বেরোনোর
সময় মা হাতে একটা ওষুধ
কোম্পানির ক্যালন্ডার দিয়ে বললো - "সামনের ফ্ল্যাটের ডাক্তারবাবু
দিয়েছেন, আমি আর কোথায়
টাঙাবো তোদের নতুন ফ্ল্যাটে টাঙাস।" এই প্রথম শাশুড়ির দেওয়া কোনও
কিছু লিলি ভালো বললো।বিশাল
ক্যালেন্ডারের পাতা জুড়ে একটি
মেয়ের মুখ
একটু ঝুঁকে সামনে চেয়ে আছে।দীঘল চোখে
এক অপার্থিব ইশারা যেন।বেডরুমের জানলার পাশে ওদের যুগল
ছবিটি সরিয়ে সেখানে টাঙানো হল।লিলির ইচ্ছে ছিলো না বিয়ের
পরপরই তোলা ছবিটা সরানোর
কিন্তু সৌমিত পাছে কিছু মনে করে বলে
চুপ করে গেলো।
আজ
অফিসে নতুন প্রজেক্টের
গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, সৌমিতের মোবাইল সারাদিনই সাইলেন্ট
মোডে ছিল।মিটিং শেষে ফোন খুলতেই
লিলির দশটা মিসড কল,তড়িঘড়ি ফোন করতেই সামনের
ফ্ল্যাটের মহিলার উদ্বিগ্ন
গলা -
"শিগগির
আসুন লিলি খুব অসুস্থ
হয়ে পড়েছে",হতচকিত সৌমিত বাড়ি ঢুকতেই মহিলা
বললেন - দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর বেডরুমে শুতে
যায় লিলি,বিকেল থেকেই
শরীরে অস্বস্তি, কোনরকমে ওনাকে ফোনে ডাকতেই উনি
এসেছেন। কী হয়েছে গুছিয়ে বলতেও পারছে না, একটাই কথা
- "আমার কেমন
যেন লাগছে"।ডাক্তার এসে ঘুমের ওষুধ
দিয়ে বিশ্রাম নিতে বলে গেলেন।প্রথম
প্রথম নানারকম উপসর্গ
হয়, কয়েকমাস গেলেই সব স্বাভাবিক হয়ে
যাবে।এখন এপ্রিল চলছে বাচ্চা হতে
হতে সেই নভেম্বর।দিশেহারা লাগে
সৌমিতের।লিলির মা এই মুহূর্তে
বিদেশে বড়ো মেয়ের কাছে,
বললেই হুট করে আসা
যায় না।সৌমিতের রিটায়ার্ড হেডমিস্ট্রেস মায়ের সঙ্গে লিলির
সম্পর্ক কোনদিনই ভালো না, আজ
কাতে পড়ে তার কাছে
সাহায্য নিতেও লিলির আতে লাগছে,রাতারাতি
সবসময়ের লোক পাওয়াও সম্ভব
না, অগত্যা পরদিন
অন্যান্য ফ্ল্যাটের মহিলারাই দায়িত্ব
নিলেন লোক না পাওয়া
অবধি ভাগাভাগি করে লিলির কাছে
থাকবার।কয়েকদিন আর এমনিতে কোন
অসুবিধা হয় নি,কিন্তু
প্রাণোচ্ছ্বল লিলি কেমন চুপ
মেরে গেছে যেন।সেদিন ডুপ্লিকেট
চাবি দিয়ে দরজা
খুলেই থমকে গেল সৌমিত,
ড্রয়িংরুমের সোফায় মাথা রেখে মাটিতে
বসে রয়েছে লিলি,গোটা বাড়ির
সব আলো জ্বলছে।সৌমিত যে
এসেছে যেন টেরই পায়
নি - "কী হলো এখানে
এভাবে শুয়ে
আছ কেন ? শরীর খারাপ লাগছে ? আমাকে ফোন
করো নি কেন ?" কোন
উত্তর নেই, সারাক্ষণ বকবক
করা মেয়েটার রসকষ যেন কেউ নিঙড়ে
নিয়েছে - দুচোখের কোনে ক্লান্তির গভীর
কালি।রাতে শোবার সময় কিছুতেই বেডরুমে
ঢুকতে চায় না লিলি
কারণ জিজ্ঞাসা করলে চুপ করে
থাকে।অগত্যা পাশের গেস্টরুমে শোয়া শুরু
হয়েছে দুজনের ।এরমধ্যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে
সৌমিত, সব দেখে শুনে
তিনি বললেন
- "প্রেগনেন্সি ব্লুজ হলে এরকম হয়।ছেলে
হবে না মেয়ে হবে,স্বাভাবিক বাচ্চা যদি না হয়,যদি বাচ্চা হতে
গিয়ে মরে যাই,সব
কিছুর জন্য স্বামীই দায়ী-- এই সব নানা
রকমের ভাবনা মিলেমিশে এরকম হয়।" পুরো
সময়টা লিলি একটাও কথা
বলেনি কোন প্রশ্নের উত্তরও দেয় নি।
আজ
দিন পাঁচেক হলো সারাদিনের একটি
কাজের মেয়ে পাওয়া গেছে। সৌমিত অফিসে বেরোনোর আগেই সে চলে
আসে, সৌমিত ফিরলে চলে যায়।এর মধ্যে
সৌমিতের মা এসে দিন
দশেক থেকে
গেছেন।লিলির ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো প্রকাশ নেই।তবে
আশ্চর্যের বিষয় হলো গেস্টরুমে সৌমিত আর লিলি শোয়
বলে মা-কে নিজেদের
বেডরুমেই শুতে বলেছিলো সৌমিত।প্রথম
দিন শোওয়ার পর মা আর
কিছুতেই ঐ ঘরে শুতে
চাইলো না।ড্রয়িংরুমের সোফায় শুয়েই অতোগুলো রাত কাটিয়ে গেলো।অবাক
সৌমিত মাকে জিজ্ঞাসা করেও
কারণ জানতে পারে নি।
অবশেষে
লিলির মা এসে যাওয়ায়
হাফ ছেড়ে বাঁচলো সবাই।আজ
গেস্টরুমে মা-এর কাছে
শুয়েছে লিলি। বহুদিন পর
সৌমিত নিজের ঘরে নিজের বিছানায়।শাশুড়ি
এসে যাওয়ায় বহুদিন পর রিলিভড সৌমিত
এ.সি চালিয়ে একটা
পাতলা চাদর জড়িয়ে শুতে
না শুতেই চোখ জড়িয়ে এসেছে।এক
ঘুমে রাত কাবার।ভোরে ঘুম
ভাঙতেই স্তব্ধ সৌমিত।সম্পূর্ণ নিরাবরণ দেহ - গায়ের চাদর মাটিতে লুটোচ্ছে।বিছানার
ওপর দিয়ে যেন ঝড়
বয়ে গেছে।খালি গায়ে ঘুম আসে
না বলে প্রথম প্রথম
খুব পেছনে লাগতো লিলি।মাথা কাজ করছে না
সৌমিতের,ঘোর লেগে আছে
চোখেও।অবাক হয়ে দেখে দেওয়ালের
ক্যালেন্ডারটা খাটের পায়ার কাছে পড়ে আছে
অথচ ফ্যানের হাওয়ায় ক্যালেন্ডারটা ওড়ে বলে যে
হ্যাঙ্গারটা ওটার ওপরে ঝুলোনো
ছিল সেটা একই জায়গায়
ঝুলছে।আস্তে আস্তে উঠে বসে সৌমিত,সারা শরীরময় এক
আশ্চর্য আবেশ - এক শিরশিরে
ভালোলাগা - এ অনুভূতি থেকে
বেশ কিছুদিন বঞ্চিত হলেও বিবাহিত সৌমিতের
অচেনা নয়।
No comments:
Post a Comment