-->

গদ্যঃ স্বপ্নকমল সরকার








করোনার দিনে প্রেম

প্রকৃতির এই সঙ্গসুখ, আহা, কখনও নিভৃতে এভাবে পেয়েছি কি? মনে পড়ে না। কতোকিছুই যে জমা হলো করোনার এইসব ঘরবন্দি দিনে। অন্তরঙ্গ কত গান শোনাল প্রতিবেশী পক্ষীকূল। বাড়ির চারপাশে যে এত পাখি, এমন যত অন্তরিন দিনেই তো চেনাজানা হলো তাদের সঙ্গে, ভালোবাসাবাসিও। 

ঘুঘুপাখির সেই বাসাটি দক্ষিণের বারান্দায় গাছের আড়ালে দিব্যি রয়েছে আজও। ছানা দু'টিকে নিয়ে মা-ঘুঘু উড়ে গেছে বেনেপুকুরের ওপাশে, জামগাছে। ঘুঘু-মা তবু রোজই বাগানে উড়ে আসে যেন তার ছানা দু'টিকে পরিত্যক্ত বাসাটি দেখিয়ে মনে করিয়ে দেয়, 'ঐ যে তোদের মামার বাড়ি!' নীলমণিলতায় ছানাদের খানিক দোল খাইয়ে তারপর ফিরে যায়। পদ্মডোবায় জল ছিটিয়ে  দুটো বসন্তবৌরি রোজই ডানা ভিজিয়ে চান করে। আমাকে দেখেও একটুও লজ্জা হয় নায তাদের। উড়ে যায়, ফিরে ফিরে আসে।

পশ্চিমের যজ্ঞডুমুর গাছের কোকিলটা প্রহর গুনে রাত দুপুরে পরপর দু'বার ঠিক ডেকে উঠবেই। অমন উচ্চকিত প্রেমালাপে সারা না দিয়ে পারে না তার দূরান্তের প্রেমিকাটি। চাঁদনি রাত অর্থবহ হয়ে উঠলে ওদের ডাকাডাকিতে আমার চোখেও ঘুম আসে না। অদেখা সেই বসন্তনিকুঞ্জবনে কখন যে মন উড়ে যায়। কান পাতি, যদি শুনতে পাই রাতট্রেনের ঝমঝম, হুইশেলের হাতছানি। হায় বড় হাহাকারময় এই স্তব্ধতা, বুকে পাষাণ হয়ে একসময় চেপে বসে নীরবতার সেই গান।কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি।

একদিন চোখ তুলে পাড়ার কুকুর ভোলানাথ আমাকে ভৎর্সনা করে,' নিজেরা তো তরিবত করে দিব্যি দুবেলা ভালোমন্দ সাঁটাচ্ছো, শুকিয়ে মরতে বসা আমাদের দেখে তোমার কি একটুও মায়া হয় না? মানুষের বাচ্চা কোথাকার!' গিন্নি ওদের মনের ভাষা বুঝে চালে-ডালে একহাঁড়ি খিচুড়ি বানিয়ে দিলেও বাবুবিবির মুখে সেসব রোচে না। তখন মাছের কাটা, ডিমের কুসুম খিচুড়িতে মাখিয়ে দিতে তবেই তাঁরা খেলেন। বুঝলাম লঙ্গরখানার খানায় ওদের পোষাবে না। এখন রোজই খাওয়ার পরে লেজ নেড়ে ওর সঙ্গিনী যেন আমাদের জিজ্ঞেস করে,'আর কতদিন লকডাউন। তোমাদের হোম কোয়ারেন্টিন?

গাঁদাল লতা আর কয়েকটা সজনের ডাল ভেঙে সঙ্গে নিয়ে রোজই ভরদুপুরে মতির মা দোরগোড়ায় এসে সাধে, 'নাও না গো, মাত্তর দশ টাকা আঁটি----পেটের রোগে খুব ভাল, বড়া করে খেও।' মতিউল্লা ফরিদাবাদে লেবারের কাজ করতে গিয়ে আটকে আছে। ওর মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। শুধু হাতে টাকা নেবে না মতির মা তাই গুচ্ছের শাকপাতা জড়ো হয় রোজই, শুকোয়, তবু ফেলে দিতে মায়া হয়, বুকে বাজে।

চেনা মানুষদেরও মুখোশের আস্তরণে দেখে কেমন যেন অচেনা লাগে। কাছাকাছি হতে দুস্তর বাধা, কেবলই যেন কানে ভাসে, 'তফাত যাও!' মানুষের সঙ্গে মানুষের এই দূরত্ব, এই সন্দেহ-শঙ্কার আবহাওয়ায় একসময়ে মনের আকাশে কালো মেঘ জমে ওঠে। মনখারাপের সেই ঘনঘটা দু'চোখে বৃষ্টি ঝরাতে পারে এমন আশঙ্কায়, একটু ভালোবাসা চেয়ে আমিও চিঠি লিখি বসন্তবালাকে। ফিরে পেতে চাই জীবনের যত রঙরূপ, যেতে চাই প্রকৃতির সেই নিবিড়তম সান্নিধ্যে। করোনার নির্বাসিত দিনে আমি কেবলই খুঁজে ফিরি ভালোবাসার হারানো সেই পাসওয়ার্ডটি।

ছবিঃ অনুষ্টুপ লাই


4 comments:

  1. গদ্য না বলে কবিতা বলতে আমার একটুও আপত্তি নেই এটিকে।

    ReplyDelete
  2. সামাজিক দূরত্বের ফসল যদি এমন হৃদয়গ্রাহী হয়,মঞ্জুর সেই শৃঙ্খল।

    ReplyDelete
  3. কবিতার মতো গদ‍্য উপহার দিলেন স্বপ্নকমল সরকার।

    ReplyDelete
  4. কবিতার মতো পদ‍্য উপহার দিলেন স্বপ্নকল সরকার

    ReplyDelete

একটি লড়াকু পত্রিকা সম্পাদকমণ্ডলীঃ   অভিজিৎ   ঘোষ ,  অনির্বাণ সরকার ,  এয়োনিয়ান   অনির্বাণ ,  সুমিত পতি ,  মনোহর হোসেন ...