-->

গল্পঃ সুব্রত দেওঘরিয়া



প্রেম অথবা অসুখের গল্প


মাথার ভেতর অজস্র রোগের কিলবিলানি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা। ছুঁতে পারছি না কারো হৃদয়। বৃষ্টিপাত হবে না একদম এবছর-- এমন কোনো আগাম সতর্কবার্তা ছিল না। আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়নি বড়ো রাস্তায় উঠলেই হজম করে নিতে হবে বংশ পরিচায়ক গালাগালি, গলার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হবে আখাম্বা বেইজ্জতির সিরিঞ্জ। তারপর যে ভঙ্গিতে ইন্টারোগেট করা হয় সন্ত্রাসবাদীদের সেভাবে জিগ্যেস করা হবে-- নাম...  সাকিন... এত বড়ো ইন্টেলিজেন্স ফেলিওরের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমরা। সত্যি বলতে এখন আর প্রস্তুত থাকা হয় না কোনো কিছুর জন্যই। নেট ফেট ছিঁড়ে গেছে কবেই। স্ট্রেইট মাঠে নামা। তারপর ইয়র্কারের পর বাউন্সার। বাউন্সার সামলে যেই ভাবলাম থিতু হয়েছি অমনি শট পিচেই বোল্ড। তারপর গ্যালারি আর কমেন্ট্রি বস্কের টিটকিরি হজম করতে করতে ফিরে আসা। আসলে এইসব আবহাওয়ায় পিচে টিকে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ। রান-ফান নিয়ে আমরা ভাবছি না আপাতত। ইদানিং কেমন একটা কনফিডেন্স চলে এসেছে আমাদের-- বোলার আম্পায়ার সামলে উঠলেও অলক্ষ্যে ভেংচি কাটছে থার্ড আম্পায়ার। প্রতিটা ডিআরএসের ফল যাবে আমাদের বিরুদ্ধে। অতএব পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। টিম মেনেজমেন্টের গোপন বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে বাড়িয়ে যেতে হবে শুধু নেট রান রেট।

অক্ষরে অক্ষরে আদেশ পালনের মতো বুদ্ধি আজকাল হয়ে গেছে আমাদের। তাই আরো নির্ভার হয়ে উঠছি। নৌকা যদি ভাঙাত্যাড়া হয় ওজন কমিয়ে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ-- এমনই একটা ভাষ্য শুনেছিলাম গোপন মিটিংয়ে।

এইতো সেদিন সরু রাস্তা দিয়ে চলেছিলাম কোথাও। এনএইচ সব আমাদের জন্য নয়। এসব বোঝার ক্ষমতা হয়ে গেছে বহু আগে। তা যেতে যেতে রাস্তা কখনো চড়াই কখনো উতরাই। কষ্ট অবশ্য ছুঁয়ে যায় না আর। তবে হঠাৎই সামনে খাদ দেখলে জোর ব্রেক কষার অভ্যেস রপ্ত করে ফেলেছি। একদম কিনারে এসে হামাগুড়ির ভঙ্গিতে আটকে গেলাম আমি। নিচ থেকে-- অবাক বিষয়-- দেখি হাত নাড়ছে মন্দিরা।-- আবার যাবি নাকি পার্কে? পার্কের কথা শুনলে আমার যুগপৎ ঘৃণা আর ভয় হয়। একটা পুলিশ ওখানে যা নয় তাই বলেছিল আমাকে। বলেছিল-- ছেঁড়া নৌকার চেয়ে আর কোনো ভালো বাহন হয় না। আপাতত জলের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তোমার করার নেই কিছু। রাগে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে হিসু করেছিলাম আমি। আর টিলা-ডুংরি পেরিয়ে হিসুর স্রোত ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল অন্য পারে বসে থাকা যুগলের তন্ময়তায়। ওরা কোরাসে চিৎকার করে উঠেছিল-- মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগম: শাশ্বতী: সমা: / যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধী: কামমোহিতম। আমার সামনে জটা-ফটা পরা এক যাত্রার সং দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

  তবুও মন্দিরাকে দেখে ভালো লাগে আমার। ফাঁক তালে খাঁচা থেকে পালাতে পারা পাখির মতো আনন্দ হয়। হাত বাড়িয়ে ওকে ছোঁয়ার চেষ্টা করি। অথচ এত খাল আছে নিচে, এত যে অন্ধকার পুষে রেখেছে কেউ বেড়ালের মতো, বুঝতে পারিনি। মরুক গে।-- কেমন আছিসখালের শূন্যস্থানে আমার কথারা ইকো করে। রাগ হয় আমার। এভাবে ভেঙচি কাটার অর্থ ছিল না কোনো। এমনিতেই কুঁকড়ে আছি আমি। যেটুকু শালপাতা জোগাড় করেছিলাম, পুড়ে শেষ। আর কোনো দহন বেঁচে নেই আমার। আগুন সম্পূর্ণ নিভে যাওয়া একটা মানুষ আমি। এখন শুধু গোত্তা খেয়ে বেড়াই চা দোকান থেকে চা দোকান। ডিএ বাড়ানোর গল্প শুনি চা খেতে আসা মানুষের। শুনি অনশনে অবস্থানে ঘটে যাওয়া মির্যাকলের কথা। কার মেয়ে নার্সিং ট্রেনিংএ যাচ্ছে আর কার মেয়ে পায়নি বলে দুঃখে সেজেগুজে ছবি দিয়েছে ফেসবুকে। আর কত কতজন তার তলায় উগরে দিয়েছে ভালবাসা হতাশা বীর্য আর রাগ। এবং তিক্ততায় তারাও নিজেদের ছবিগুলোকে সাজিয়ে তোলার কাজে লাল কাঁকড়া খুঁজে বেড়াচ্ছে।


  অতএব এইসব ভ্যাংচানি ট্যাংচানির কোনো অর্থ হয় না। আমাদের হওয়ার নেই কিছুই। আমাদের মন্দিরারা এভাবেই গভীর গর্ত থেকে টুকি দেবে। তারপর ঘুড়ি উড়বে আকাশে প্রজাপতি উড়বে উড়ে যাবে মন্দিরা। দ্বিতীয়বার ডাকতে পারতাম আমি। অথচ দু পা ফাঁক করে একটু বসার ইচ্ছে হল আমার। এখানে ফুলের গন্ধ বাতাস। এত গন্ধ পরাগরেনু সহ্য করতে পারছি না আমি। খাদের তলায় হয়ত বড়ো কোনো বাগান রয়েছে। অতীত আর ভবিষ্যতের যুগলেরা সেখানে প্রেম করছে খাবার খাচ্ছে হিসি করছে আর -ওর দিকে তাকিয়ে বলছে-- আকাশে আর কোনো তারা নেই। আর কোনো ঘুম নেই আমাদের। সেইসব ফুলেদের ভারী ভারী গন্ধ মিলিটারী বুটের মতো অসহ্য লাগছে আমার। দুপা ঝুলিয়ে বসে পড়লাম তাই। কিছুক্ষণ ধরে নিশ্বাস বন্ধ রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।


  এভাবেই ঝুলন্ত বেঁচে থাকা ছাড়া করার আর কিছু নেই। এই গভীর উপলব্ধির জন্য আরো খানিকটা সময় নেওয়া দরকার ছিল আমার।  আবার বোধ চলে এলে বসে থাকা নিরর্থক। ডানহাতের উপর ভর দিয়ে ক্রমশ পিছিয়ে এলাম আমি। শেষবারের মতো আধ ঝোলা অবস্থায় দেখার চেষ্টা করলাম মন্দিরাকে। অথচ পার্কের পুলিশ ততক্ষণে ধরে ফেলেছে ওকে। জানিয়ে দিয়েছে-- সস্তার  টিকিটে এর চেয়ে বেশিক্ষণ নয়। নৌকাডুবি হয়ে গেলে দান খয়রাত করি না আমরা।


  আগের চড়াইগুলো এখন উতরাই হয়ে গেছে। আবার উল্টোটাও হওয়া উচিৎ ছিল। হয়নি। সেই আদিগন্ত উতরাই দিয়ে গড়িয়ে নামছি আমি। অবশ্য সমস্ত অ্যাকশনেই কাট টেক শট বলার জন্য ডিরেক্টর থাকে। জানি ঠিক কোথায় থেমে যেতে হবে আমাকে। পোড় খাওয়া আর্টিস্টের মতো ডিরেক্টরের মতিগতি ইদানিং বুঝে গেছি আমি। দেখলাম লঙশটে প্রীতমা উঠে আসছে পুকুর ঘাট থেকে এক কোমর বাসন দুলিয়ে। শব্দটুকু আমি নিজের ভেতর পুষে রাখার চেষ্টা করি। তখনই বড়ো বটগাছটার তলা থেকে বেরিয়ে আসে কালোকোলো ছোঁড়াটা। একটা চিঠি দেয় প্রীতমার হাতে। লজ্জায় লাল হয়ে যায় প্রীতমার কান গাল সারাটা শরীর। এদিক ওদিক তাকিয়ে বাসনের ডাঁইয়ের মধ্যে লুকিয়ে নেয়  চিঠিটা। ধুমসো মতো একটা লোক একদিন পথ আটকে ছিল আমার। বলেছিল-- এখানে দাঁড়াবে তুমি রোজ। আর পাঁচটা কাজের ভেতর এটাও তোমার দায়িত্ব। আমি কোনো প্রশ্ন করিনি। লোকটার তর্জনী কাঁপছিল খুব। রেগে গেছিল, না ভয় পাচ্ছিল জানি না। কোনো রিস্ক নিইনি আমি। রাজি না হলে কী করত সে জানা নেই। তবে রাজি আমাকে হতেই হত। সব কথার এত ব্যাখ্যা থাকে না। ঘটে যাওয়ার নাম ঘটনা। আর ঘটনার পিছনে ডিরেক্টর। এবং গোল করে বাঁধা দড়ির ওপারে সাক্ষীগোপাল। এই হল ছক। ছকের বাইরে ঘটে না কিছুই। অতএব অবাক হওয়ার মতো কারণও কিছু নেই। গোল গোল বিষয়ের ভেতর ঘুরে আমাকে বেড়াতেই হবে।অবশ্য চিঠি নেওয়ার পরের গল্প জানার ইচ্ছে থাকলেও উপায় আমার নেই। ধুমসো লোকটা বলে গেছে-- নিজের সিলেবাসে মন দাও। যে কোনো সময় চোখের ওপর হাজার ওয়াটের আলো পড়তে পারে। জানবে সবই লৌকিক। অস্বাভাবিক বলে হয় না কিছু পৃথিবীতে।


  পুকুর পাড়ে মুহূর্তটায় স্থির হয়ে যায় সব। সময় সতত গতিশীল নয়। ওকেও আটকে রাখা যায়। কেমন একটা থম মারা ঝিমুনির ভেতর ঢুকে পড়ি আমি। সেই ঝিমুনি বাড়তে থাকলেই আবার গোত্তা। আবার সেই উতরাই দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নামা। এতে আমার ছাল-চামড়া ছড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেরকম কিছুই হয় না। কেমন যেন ক্রমাগত সিজনড হয়ে যাচ্ছে সব। শুধু সময়টাতেই রোজ ঘণ্টা বাজে মেয়েদের স্কুলে আর একরঙা মেয়েগুলো রাস্তার ধারে সার দিয়ে অপেক্ষা করে আমাকে দেখার জন্য। ওরা ভাবে আমি কোনো ম্যাজিশিয়ান অথবা ক্লাউন। ওদের নীল-সাদা বিল্ডিং এর পাশ দিয়ে, ওদের সাইকেল আর সকালের পারফিউমের সাথে ঘামের গন্ধ মেশা আঁশটে আবহাওয়ার পাশ দিয়ে এক মজার খেলা আমার। আর আমি পর পর বাম দিকে টার্ন নিয়ে যাই। কারণ জাতীয় সড়ক এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।


  এদিকে আর কোনো খাদ নেই। শুধু নোনতা বাতাস এসে লাগে গায়ে। মনে হয় ধারেকাছে সমুদ্র আছে কোথাও। বহুদূর থেকে কোলাহল ভেসে আসে। তবে কি সারিয়ে ফেলা হল ভাঙা নৌকা? 'মা নিষাদ' বলে ওঠা যুগলেরা মাছের গন্ধ গায়ে মেখে মাঝ সমুদ্রে এবার হারিয়ে গেছে নিজেদের তন্ময়তায়? প্রীতমা আর সেই কালোকোলো ছোঁড়াটারও কি জায়গা হয়েছে কোথাওসমুদ্রের দুপাড়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখে চলেছে মেয়েদের স্কুলের ছুটি হওয়া মেয়েগুলো? উল্লাসে সি বিচে সাইকেল ছোটাচ্ছে ওরা? ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে স্কুলের ব্যাগ? কেউ কেউ আনন্দে সিটি বাজাচ্ছে, অথবা গেয়ে ফেলছে চলতি গানের দুটো কলি? ওদেরই এক কোনায় পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসা মন্দিরাও দাঁড়িয়ে আছে? আর হয়ত বা ডিউটি ফিউটি ভুলে পুলিশেরাও যোগ দিয়েছে এই অনন্ত কার্নিভালে!


  অথবা এই শব্দও সেই খাদের মতোই শেষমেশ যা আমাদের পৌঁছাবে না কোথাও। ওখানে গিয়ে দেখব ইশারা করছে মন্দিরা-- জিগ্যেস করছে-- যাবি নাকি-- কোথায়, পার্কে-- না, অন্য কোথাও-- কোথায়-- তুই বল -- জায়গাগুলো এখন ভীষণভাবে কমে আসছে-- কেন--নেতার ছেলের অন্নপ্রাশনের জন্য আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে সব রাস্তায়--আর-- মাথার ভেতর কিলবিল করছে অসুখ-- আর-- ছুঁতে পারছি না কেউ কারো হৃদয়-- আর-- কারো শরীর-- কেন ------ প্রশ্নের উত্তর ভাবতে ভাবতে আবারও ওরা তাড়া করবে মন্দিরাকে। আমার উত্তর শূন্যস্থানে প্রতিধ্বনিত হয়ে ভ্যাঙচি কাটবে আমাকেই।

1 comment:

একটি লড়াকু পত্রিকা সম্পাদকমণ্ডলীঃ   অভিজিৎ   ঘোষ ,  অনির্বাণ সরকার ,  এয়োনিয়ান   অনির্বাণ ,  সুমিত পতি ,  মনোহর হোসেন ...