-->

আঁচঃ এয়োনিয়ান অনির্বাণের ধারাবাহিক গদ্য




রাস্তার দাবি  


রাজাকে মারব
আমার যুদ্ধ জারি
আমার যুদ্ধ ভাত ডাল তরকারি
আমার যুদ্ধ পাকস্থলীতে নাচে
রাজাকে মেরেই ঝলসিয়ে খাবো
আমার ক্ষিদের আঁচে..."
  (রেড স্যালুট/রঞ্জন আচার্য)

পেন ইজ মাইটার দ্যান দা সোর্ড।এটি একটি নিছক ন্যাকা সান্ত্বনা বাক্য ছাড়া আর কিছু নয়। টাঙ্গি-কাটারি-বন্দুক চালাতে পারছি না বলে কলম চালাচ্ছি। এতে কতটা কাজের কাজ হয় তাই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাই সেইসব শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-কবি ও কেরানি  যাঁঁরা এখনো অন্তত নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে নেই তাঁঁদের কাছে প্রশ্ন, এমন কোনো লেখা কী লেখা যায় যে লেখা ঔরঙ্গবাদের রেল লাইনের ওপর চাপ চাপ রক্ত মজ্জা ঘিলু আর এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা রুটি গুলোর হয়ে প্রতিশোধ নেবে ? লিখেছেন নাকি কেউ এমন কোনো প্রবন্ধ বা কবিতা যা পড়ে তৃপ্ত হবে, শান্ত হবে 'বাবা কেন এল না ?' ভাবতে থাকা পুরুলিয়ার ছেলেটা ? লিখেছেন কেউ ?

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী অস্বাভাবিক দ্রুত হারে হচ্ছিল ভারতবর্ষের শ্রমিকদের মাইগ্রেশন। রিয়েল এস্টেট সেক্টরের বাড় বাড়ছিল চমকে দেওয়ার মতো গতিতে। প্রয়োজন পড়ছিল সস্তার শ্রমিকের। সুতরাং গ্রাম থেকে সস্তার শ্রমিকগুলোকে টেনে আনতে হবে শহরে। আহমেদাবাদ-মুম্বাই-নয়ডার বাটপার বেনিয়ারা দালাল লাগিয়ে জাল ফেলল বাংলা,বিহার উড়িষ্যা,ঝাড়খন্ড,মধ্যপ্রদেশ,ছত্তিশগড়ের গ্রামে গ্রামে। অর্থনীতির ভাষায় Pull factor । তবে কিনা সেটাই যথেষ্ট নয় । এর সাথে একটা Push factor-ও চাই! যা কিনা গ্রামের লোকগুলোকে গ্রাম থেকে ঠেলে তাড়িয়ে দেবে শহরের দিকে। তাই চাষকে অলাভজনক করার ষড়যন্ত্র শুরু হল। সারের দাম বাড়িয়ে, বীজের দাম বাড়িয়ে , ঋণের ফাঁদে ফেলে প্রতি কুড়ি মিনিটে একটা চাষীকে আত্মহত্যায় বাধ্য করিয়ে লোকগুলোকে গ্রাম থেকে ঠেলে তাড়ানো হল ।Push factor!

তারপর ? তারপর শহরে এদের ক্রীতদাস করে রাখা হল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বন্ডে সই করানো, ভোটার কার্ড-রেশন কার্ড জমা রাখা,মাইনে বাকি রাখা এসব তো ছিলই। পাশাপাশি পুলিশ দিয়ে উকিল দিয়ে শাসানোও ছিল। ভাবখানা এমন যে, এসে যখন পড়েছো বাছা আর তোমায় ছাড়ছি না। বাঁধা মজুর হয়ে খাটতে হবে পুরোটা যৌবনকাল। এমন সস্তার শ্রমিককে  কী ছেড়ে দেওয়া যায়! ক্রীতদাসদের কে কবে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছে! মিশরের ফ্যারাও ছেড়েছিল বনি ইসরায়েলিদের ? রোমানরা ছেড়ে ছিল স্পার্টাকাসদের ?

তাই মাত্র তিনদিনের নোটিশে লকডাউন ঘোষণা হল ,যাতে ব্যাটারা পালাতে না পারে। তাই বিলেত থেকে বড়লোকদের ,বড়লোকের বাচ্চাদের উড়োজাহাজে করে দ্রুত ফেরানো হয়, ভিনরাজ্যে বেসরকারি কোচিং সেন্টারে পড়তে যাওয়া উচ্চ মধ্যবিত্তদের বাচ্চা গুলোকেও ফেরানোর হয় কিন্তু লক্ষ্য রাখা হয় যেন ক্রীতদাসগুলো পালাতে না পারে।

কিন্তু হায়। ক্রীতদাসরা তো ঠিক পালায় ! একটা হারামি অর্থনীতির বোকাচোদা রাষ্ট্রনায়কগুলো যা ভাবতেও পারেনি তাই ঘটলো। EXODUS ! কোনো মোজেস,মহাত্মা,মাও কারও দরকার পড়ল না। শুরু হল হাঁটা । শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে। ঘরের দিকে হাঁটা। এক অদ্ভুত জেদ, কঠিন রোখ্, আর বুকভরা 'মহতী ঘৃণা'-কে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা। মাইল-মাইল-মাইল হাঁটা। দিনে সূর্য আর রাতে কালপুরুষকে মাথার ওপর সাক্ষী রেখে রাস্তায় নেমে এলো ভারতবর্ষ।

ষড়যন্ত্রী মালিককুল আর তাদের পোষা রাজনীতিকগুলো ভয় পেল। যখনই এরকম কোন কিছু ঘটতে থাকে যা তাদের প্ল্যানের মধ্যে ছিল না তখনই তা শোষককে ভয় ধরায়। সুতরাং ?
সুতরাং পুলিশ দিয়ে লাঠিচার্জ। একটা দুটো খুন। মোটমাট ভয় ধরাতে হবে ক্রীতদাসগুলোকে। যাতে হাঁটতে ভয় পায়। তাই 'নাইট কারফিউ'! তাই ট্রেনে চাপা দিলে দালাল মিডিয়া প্রশ্ন তুলে "রেল লাইনে কেন ঘুমাবে ?"

ঠিকই তো। এই তো এদের নিশ্চিত পরিণতি। রেললাইনে ঘুমোনোর বদলে এরা কি ভেবেছিল রেললাইন উপড়ে ফেলার কথা ? ট্রেনের ড্রাইভার কে গানপয়েন্টে নিয়ে ট্রেন হাইজ্যাক করার কথাও নিশ্চই ভাবেনি।
কেন ?

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে স্ট্রিট লাইটগুলোও ভাঙেনি। কেন ?

কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ত্রাণ নিয়ে গেলে বলেনি, "ওরে বোকাচোদা, আমরা হলাম প্রলেতারিয়েত। মার্ক্সের ভাষায়  'রিজার্ভ আর্মি অব লেবার'। "ত্রাণ নয় , বন্দুক দে। টাঙ্গি কাটারি দে। খাবার লুঠে খাবো!" কই এরকম তো বলেনি।
বলেনি কেন ?

যে কথা বলছিলাম। লিখেছেন কেউ এমন কোনো লেখা যা ক্ষুধার্তের পেট ভরায়। লিখেছেন কেউ এমন লেখা যা এনে দিতে পারে বহু প্রতীক্ষিত সেই 'প্রতিশোধ' ?

মোজেসের নেতৃত্বে ইজরায়েলি ক্রীতদাসদের মিশর ছেড়ে যাওয়ার গল্প (এক্সুডাস) আমরা জানি। আমরা কী ভুলে গেছি জিহোবার প্রতিশোধের কথা ? মহতী শ্রেণিঘৃণার কথা ? মুক্তির আগে প্রতিশোধ নিতে প্রতিটি মিশরীয় পরিবারের বড় ছেলেকে  এক-রাতে হত্যা করেছিলেন জিহোবা।বাদ যায়নি গবাদি পশুও।

রাস্তায় ভূমিষ্ঠ হওয়া মরা শিশু আর মরা মায়ের লাশ, রাস্তায় লরিতে চাপা পড়া শ্রমিকের শেষ অস্ফুট চিৎকার আর রেল লাইনে ছড়িয়ে থাকা রক্ত আর  ঘিলু মাখা রুটিগুলো ফিসফিসিয়ে আপনার কাছে একটাই দাবি তুলছে... ।

ছবি গুগ্‌ল থেকে সংগৃহীত

5 comments:

  1. দাস প্রথা এখনও চলছে। দাসরাই এক দিন দাস ক্যাপিটাল আবার লিখে দেবে, এ আমার বিশ্বাস। খুব ভাল লেখা হয়েছে।

    ReplyDelete
  2. খুউব যুক্তিপূর্ণ, ভালো একটা লেখা পড়লাম। চোখে চোখ রেখে জবাব চাওয়া একটা লেখা... সব গোপন খেল্ খতম করে দেওয়া একটা লেখা...

    ReplyDelete
  3. Rozina Yeasmin24 May 2020 at 03:57

    খুব নির্মম সত্য। আরো নির্মমভাবে চাবুক মার, যতক্ষণ না বিবেকের ঘিলুগুলো ছিটকে ওঠে, এখনো অনেক উত্তর চাওয়ার বাকি আছে। অনেক হিসেব মেলে না এখনো। সেগুলো মেলানো বাকি।

    ReplyDelete

একটি লড়াকু পত্রিকা সম্পাদকমণ্ডলীঃ   অভিজিৎ   ঘোষ ,  অনির্বাণ সরকার ,  এয়োনিয়ান   অনির্বাণ ,  সুমিত পতি ,  মনোহর হোসেন ...