-->

থিয়েটার থেকে বলছিঃ উদয়শংকর মুখোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক গদ্য






সোশ্যাল ডিসটেন্স......মরণ তুঁহু মম শ্যাম

থালা বাটি বেজেছিলো। জ্বললো মোমবাতিও। শঙ্খধ্বনি হলো। পটাপট ফাটলো শব্দবাজি।কত ডেসিবেল আওয়াজ হলো তা যাঁঁরা ফাটালো তাঁঁরা পারবেন বলতে।শুনলাম পুড়ে ছাই হলো বাঁশবাগানও।কিন্তু বস street light গুলো নেভালো কারা ? লোকাল সোহাগ চাঁদ বদনেরা ? এদিকে কেউ কেউ আঁধার না করে মোমবাতি জ্বালায়নি বলে কারো কারো চোখে করোনার থেকেও বিষ রে মাইরি...তবু ভাইরাস তো মরে নাই...বিষ তো চুমু খেয়েই চলেছে হামদের গালে... 
আচ্ছা আমি কী একটু পলিকিটিক্যাল থুরি পলিটিক্যাল হয়ে যাচ্ছি ?

চারদিকে এখন রাজনীতি করবেন না, রাজনীতি করবেন না বলে যা ঢেকুর তুলছে নেটিজেনরা...কিছু মনে করবেন না, এই নেটিজেন শব্দটা শুনলে মাইরি বলছি আমার কেমন নেংটি ইঁদুর শব্দের যমজ ভাই মনে হয়...

নেটিজেন = নেংটি ইঁদুর

ও হ্যাঁঁ, যা বলছিলাম...যে দিন থেকে লক ডাউন চালু হয়েছে সত্যি বলছি ঠিক সেদিন থেকে একটা বুক দুর দুর করা গা ছমছমে ইয়ে তে ভুগছি।
না না করোনাকে জড়িয়ে ধরে অমৃতলোকে যাওয়ার ভয় নয়।

ইয়ে মানে ঐ যে পলিটিক্যাল না আ-পলিটিক্যাল কোন কতা কইবো শালা বুঝতেই পারছি না। হাঁ করলেই হাওড়া আর ল্যা করলেই কী যে সব বুঝে যাবে নেংটি ইঁদুরেরা থুরি নেটিজেনরা বুঝতেই তো পারছিনাকো। ইদিকে এই যে এত্ত বচ্ছরের থিয়েটার করিয়ে লোক আমি। আ-পলিটিক্যাল কতা মানে সোনার পাথরবাটিতে ছানার পায়েস খাওয়া সেটা যে কী করে বোঝাই সে রাস্তা খুঁজেই পাচ্ছি কৈ?
জানেন এবারের নতুন নাটক করবো বলে গত 14 এপ্রিল হল বুক করে ছিলাম। কিন্তু করোনার সারা বিশ্বপ্রেমের জোয়ারে আমার বুক করা ডেট অনির্দিষ্টকালের জন্য ভ্রমণে গেছেন, কবে ফিরবেন করোনার ভ্যাকসিনই হয়তো জানে। দেশের বাবা তো বলেই দিয়েছেন মাঝে মধ্যে রাত আটটায় জ্ঞান
বাক্সে দাঁত কেলিয়ে মুখ দেখাবেন, হোম টাস্ক দেবেন,খয়রাতি গুনে নেবেন, সাধু, চদু,চোরেদের হামি খাবেন,পূর্ণিমার চাঁদ দেখবেন আর নেংটি ইঁদুরেরা থুরি নেটিজেনরা শরীরের যেখানে যত কালো রঙের লম্বা লম্বা লোম আছে গুনে গুনে ছিঁড়বে.....লক ডাউন উঠে গেলে বাবার চ্যালারা ওগুলি বেচে দেশের অর্থনীতির ধ্বজা পত পত করে উড়াবেন।

যা শালা... এ করছি আমি ? বাঘের ঘরে যে বেড়াল ছেড়ে দিচ্ছি ? আবার তো রাজনীতির আঁশটে গন্ধ ছড়াচ্ছি ? থিয়েটার নিয়ে লিখতে বসে কী সব লিখছি ?

 থিয়েটার নেই, মহড়া নেই, নেই আমার সহ অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাথে আড্ডা। থিয়েটারে আসা নতুনদের বকাঝকা নেই। একটা সিগারেটে চার জনের টান নেই। এক বুক জান নেই। বুকের খাঁচায় বল নেই। একের মুখে অন্যের কথা নেই। হাতের ছোঁয়া নেই...আঙুলে আঙুল নেই...
আছে...

 রাজার বুলি আছে। মুখে মুখোশ আছে। রাণীর চুলবুলি আছে। করোনার ছোবল আছে। মরণের মিথ্যে আছে। পায়ে হাঁটা শ্রমিক আছে। রেলের সজ্জায় মৃত্যু আছে। কমিউনিটি কিচেন আছে। সরকারি মিথ্যে আছে...

এই রে আবার কী পিলিকিটিক্যাল থুরি পলিটিক্যাল হয়ে গেল ? আচ্ছা কী মনে হচ্ছে ?  আমি ছ্যাবলামি করছি ??? আরে শালা আমার দেশটাকে নিয়ে ছ্যাবলামিই তো চলছে।
 কী বলেন ? রয়্যাল ছ্যাবলামি। রয়্যাল।
আর থিয়েটার নিয়ে ???

সে ছ্যাবলামি তো করোনাময়ী লক ডাউনের কত্ত আগেই থেকেই চালু রেখেছে দেশ আমার। স্বাধীনতা পার করে কত বছর করে কাটিয়ে দিলুম....দেশের বাপ ঠাকুর্দারা তো গুছিয়ে গুছিয়ে থিয়েটারের গুষ্টির শীতলা পুজো করে রেখেছেন। গালভরা নামের ওপর ভর দিয়ে থিয়েটারের চর্চা চলেই আসছে, তবু একটা করোনা এলে থিয়েটারের সর্বক্ষণের ছেলেমেয়েরা যারা থিয়েটার নিয়েই বাঁচবে ভাবছে তারা
টোটো চালাচ্ছে... বিক্রি করছে সবজি... বাড়ি বাড়ি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দিচ্ছে নিজেদের পেট ভরাতে... ইদিকে দেশ সিকিওর করে দিয়েছে... দুচারটে খুন করো, পিস্তল চালানোর পি এইচ ডি নিয়ে জনগণকে চমকানোর থিসিস লেখো। নেতা বা মন্ত্রী হও ওনলি পাঁচ বছর।ব্যস... তোমার গুষ্টি... পরের গুষ্টি... পরের গুষ্টি..... পরের গুষ্টি মিলিয়ে কত গুষ্টি রসে বসে মাংসে গুছিয়ে খাবে তা বহ্মাও জানে না।

দেশনায়করা.... এমনকি স্কুলের রাস্তা না দেখা পাড়ার নেতাও হুঙ্কার ছাড়বেন " শুধু থিয়েটার করলে হবে ? পেট চালাতে গেলে তো কিছু কাজ করতে হবে? "
আরে মরা... থিয়েটারের মতো কঠিন কাজ কটা আছে রে?
পড়াশুনা করো,শৃঙ্খলা শেখো,থিয়েটারের দলে যোগ দাও, মহড়ার পর মহড়া করো... নাটকের শো করো... শো শেষে পোলট্রির সেদ্ধ ডিম নিয়ে বাড়ি যাও... রাতে স্বপ্ন দেখো তোমার অভিনয় দেখার জন্য পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ সাজানো...

ঘুম ভাঙলেই টের পাও সেই সাজানো বাগানে কোটি কোটি ভিমরুল হুল নিয়ে ভালোবাসা জানাতে উড়ে বেড়াচ্ছে... ভিমরুলের ছোবল খাবার জন্য তৈরি থাকো। ছানা কেটে যায় স্বপ্ন। থিয়েটারের শিশু পেরোবে কী করে কৈশোর ? থিয়েটারের দাদারা তো কোথাও না কোথাও আগে থেকেই বানিয়ে রেখেছেন সোশ্যাল ডিসটেন্স... রাষ্ট্র... রাজনীতি... ও থিয়েটার আলাদা এক একটা দূরত্ব... এ তো করোনার থেকেও ভয়ংকর।

নাসিরুদ্দিন শাহ একটা সাক্ষাৎকারে বলছেন যে, দেশে একটি জাতীয় নাট্যশালা যার নাম National School Of Drama...

দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে ছেলেমেয়েরা আসেন নাট্যশিক্ষায় শিক্ষিত হতে... পড়তে... জানতে... তারপর তাঁঁদের সেখানে হিন্দিতে থিয়েটার করতে হয়...

উনি বলছেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ছেলেমেয়েরা NSD তে কেন হিন্দিতে থিয়েটার করবেন ? কেন প্রত্যেকের ভাষায় থিয়েটার করার জন্য প্রত্যেক রাজ্যে জাতীয় নাট্যশালা থাকবে না ?
নাসিরের কথার উপর পেচ্ছাব করে দিয়েছে দেশের বাবারা।

আসলে দিল্লির নাট্যশালার প্রতিভাবান অভিনেতারা বেরিয়ে বলিউড ইন্ডাস্ট্রির দরজায় কড়া নাড়বেন...

কেউ কেউ তাগড়াই সেলেব হবেন। আর দেশের বাকি নাট্যশিল্পীরা যাঁঁরা রাষ্ট্রীয় নাট্যশালায় ঢোকার চান্স পেলেন না তাঁঁরা থিয়েটারের পাশাপাশি পেট চালাতে সমান্তরাল পেশা খুঁজতে গিয়ে ভুতি চুষবেন... নাট্যশালার পাশ করা প্রতিভা... আর চান্স না পাওয়া শিল্পী... সোশ্যাল ডিসটেন্সই তো। তবে এর মধ্যে আবার থিয়েটারের বড় দল, মেজো দল, সেজো দল, ছোট দলের তকমা আঁটা শিলমোহর আছে। সে ছাপটি মারিবেন কোন এক শিব ঠাকুর।

এই শিবঠাকুরেরা ছিলিম টানেন,টানতে শেখান।তাঁদের বিষ করোনার থেকেও মরণমুখী বেশি। এঁঁরা মনে করেন আমাদের থিয়েটারে এঁঁরাই সেলিব্রিটি বানান আর বাকিদের হাতে ধরান আধখাওয়া কলা।  বড় দলের থিয়েটার। বড় সেলেব অভিনেতা। যেকোন নাটকে তিনিই প্রধান অভিনেতা। চরিত্রে ফিট করুক বা না করুক। শো শেষে মোটা টাকা নিয়ে বাড়ি যাবেন চারচাকায় চড়ে।আর স্বপ্ন দেখছে যারা তারা সরকারি বাসে চড়ে খানিকটা পায়ে হেঁটে গভীর রাতে মায়ের রান্নায় পেট ভরিয়ে সকালে উঠে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখবে শো-এর পারিশ্রমিক একশো টাকা...

চারচাকা... সরকারি বাস... এই ডিসটেন্স তো করোনা তৈরি করেনি। থিয়েটার করাও যে একটা কঠিন কাজ যার বিনিময়ে সুন্দর ভাবে পেট ভরানো যায় এই সত্যটাকে মিথ্যের মিথ  তৈরি করেছে রাষ্ট্র...

এটাও তো কিং সাইজের ডিসটেন্স। বড় দল... বাঘা ডিরেকটর... দাড়ি চুল নিয়ে প্রতিভার ককটেল... ঝুঁকি নিতে পারে না অক্লান্ত পরিশ্রম করা কোন অভিনেতার উপর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করাবার। ভাড়া করতেই হয় বড় দাদা দিদি অভিনেতাদের  যাঁঁদের গায়ে সিরিয়াল, সিনেমার বোঁঁটকা গন্ধ লেগে আছে। পরিশ্রম করা অভিনেতারা একবুক থিয়েটার শিক্ষা নিয়ে দিনের পর দিন
দাদা দিদিদের পিছনের সারির ভিড়ে হেঁটে চলে... একশো টাকা পকেটে নিয়ে...  এই ডিসটেন্স তো বাড়ছে বস। বাড়বে। এদিকে করোনা এসে দাঁত ক্যালাচ্ছে। সে তো চোখে আঙুল দিয়ে আরো দেখিয়ে দিলো সেলেবগুলো এই মে মাসের গরমে এসিতে শুয়ে নাক ডাকছেন,একশো টাকার শিল্পীরা বাড়ি বাড়ি স্যানিটাইজার বেচছে... বাঁচতে চাইছে তারা আবার মঞ্চে থিয়েটার করবে বলে। বাঁচতে চাওয়া... স্বপ্ন দেখা... আবার মঞ্চে যাওয়া...  এও তো এক চকচকে দূরত্ব। এ দূরত্ব মেটাতে রাষ্ট্র রেললাইনের মতো বাড়িয়েই চলেছে দূরত্ব। বড় দল... সেলেব... স্বপ্ন দেখা শিল্পী... চারচাকা... একশো টাকা... এসবের মাঝেই আছে রাজকোষ থেকে হাতিয়ে আনা অর্থ... ঐ ব্রহ্মা সব জানেন। ব্রহ্মা রাজকোষের টাকা বিলান চিংড়ি বাছা করে... রাজকোষ থেকে অর্থ পাওয়াতেও তো দূরত্ব তৈরি করে রেখেছেন বড়দা মেজদা ছোড়দারা... মেজো-সেজোদের মধ্যে আবার রাজকোষ হাতিয়ে আনার যে ফন্দি ফিকির তা ম্যানেজমেন্টের কোর্সকেও হার মানায়। এই মেজো-সেজোদের বলা যায় কলির কেষ্ট... ঐ মাথায় অক্সিজেন সাপ্লাই কম কেষ্ট নয়... এ হলো অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের মিশ্রণে তৈরি ধিনি কেষ্ট...


No comments:

Post a Comment

একটি লড়াকু পত্রিকা সম্পাদকমণ্ডলীঃ   অভিজিৎ   ঘোষ ,  অনির্বাণ সরকার ,  এয়োনিয়ান   অনির্বাণ ,  সুমিত পতি ,  মনোহর হোসেন ...