-->

গদ্যঃ অভিজিৎ দাশগুপ্ত




সম্পর্কের এক যুগ : অক্ষয়কুমার ও দেবেন্দ্রনাথ

এক
 “সম্প্রতি এই পত্রের বিশেষ তাৎপর্য্য ব্যক্ত করিবার জন্য ইহার সংক্ষেপ বিবরণ নিম্নদেশে প্রকাশ করিতেছি। এতং পত্রে এমত সকল বিষয়ের আলোচনা হইবেক, যদ্বারা বঙ্গভাষায় লিপি বিদ্যার বর্তমান রীতি উত্তম হইয়া সহজে ভাব প্রকাশের উপায় হইতে পারে। যত্নপূর্ব্বক নীতি, ও ইতিহাস, এবং বিজ্ঞান প্রভৃতি বহু বিদ্যার বৃদ্ধি নিমিত্ত নানা প্রকার গ্রন্থের অনুবাদ করা যাইবেক, ...এবং উত্তম২ কবিতা যিনি লিখিয়া প্রেরণ করিবেন তাহা অবশ্য আমারদিগের বিচারের সহিত প্রকাশ করিতে ত্রুটি করিব না”।
                                                            ‘বিদ্যাদর্শন’ (মাসিক) প্রথম সংখ্যা, ১৮৪২ জুন।   
                                                                             পত্র-প্রচারের  উদ্দেশ্য।
“.....কিন্তু অক্ষয়বাবুর চেষ্টায় ইহাতে (‘তত্ত্ববোধিনী’) ধর্ম্ম বিষয় ব্যতীত, সাহিত্য, বিজ্ঞান পুরাতত্ত্বাদি উৎকৃষ্ট বিষয়গুলি আলোচিত হইতে আরম্ভ হয়”।
                                                                     -‘অক্ষয়চরিত’, নকুড়চন্দ্র বিশ্বাস।
            শুরুতেই দুই ভিন্ন পত্রিকার লেখা সম্বন্ধে অক্ষয়কুমার দত্তের চিন্তা তুলে ধরলাম। কিন্তু পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য। এ বিষয়েও ভাবনা প্রকাশ করেছেন উনিশ শতকের এই জ্ঞান তাপস। যেমন ‘বিদ্যাদর্শন’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই তিনি জানাচ্ছেন,
-      “.....এবং দেশীয় কুরীতির প্রতি বহুবিধ যুক্তি ও প্রমাণ দর্শাইয়া তাহার নিবৃত্তির চেষ্টা হইবেক”।
ঠিক একই প্রসঙ্গ ফিরে আসবে এক বছর পর, যখন তিনি ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’-র প্রকাশ উপলক্ষ্যে উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা  করবেন।
“কুকর্ম্ম হইতে নিবৃত্ত হইবার চেষ্টা না থাকিলে ব্রহ্মজ্ঞানে প্রবৃত্তি হয় না, অতএব যাহাতে লোকে কুকর্ম্ম হইতে নিবৃত্ত থাকিবার চেষ্টা হয় এবং মন পরিশুদ্ধ হয় এমত সকল উপদেশ প্রদত্ত হইবেক”।

দুই

মাসিক ‘বিদ্যাদর্শন’ পত্রিকাটি অক্ষয়কুমার দত্ত টাকী-নিবাসী প্রসন্নকুমার ঘোষের সঙ্গে প্রকাশ করেন। মাত্র ছয়টি সংখ্যা (দুটি সংখ্যা- সংসদ বাঙালি চিরতাবিধান) প্রকাশের পর বন্ধ হয়ে যায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ প্রবল থাকায়,  তাকে উত্তম রূপ দেওয়ার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন তিনি। নিজে ভীতচিত্তে যে পথ অবলম্বন করেছেন, সেই পথে এগিয়ে আসতে বলেছেন শিক্ষার্থীদের। কিন্তু  তাদের ভেতরেও সংশয় থাকবে,  থাকবে নতুনকে জানার এক প্রকার তার্কিক মন। আসলে ‘তর্ক’-র অর্থ তো অনেক হয়। যেমন-বিতর্ক, বাদানুবাদ, বিচার, যুক্তি ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে অনুমান, হেতু, সন্দেহ, বচসাও। অক্ষয়কুমার তাঁর শিক্ষা ও মুক্ত বিশ্বাসের জন্যই ছাত্রদের ক্ষেত্রেও তার একটি পথ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। হতে পারে, মাত্র ছয়টি  সংখ্যা ‘বিদ্যাদর্শনে’র আয়ু, কিন্তু তাতে এর গুরুত্ব কমছে না।
দ্বিতীয় যে পত্রিকাটি অক্ষয়কুমারকে পাদ প্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে, সেটি হল ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’। মাসিক এই পত্রটির প্রথম প্রকাশ ১৮৪৩, ১৬ আগষ্ট (১৭৬৫ শক, ১লা ভাদ্র)। এই পত্রিকার সঙ্গে তাঁর বারো  বৎসরের (১৮৪৩-১৮৫৫) সম্পর্ক। ৩০ টাকা বেতনে নিযুক্ত হয়ে শেষে  ৬০ টাকায় গিয়ে পৌঁছায়। তথ্য বলছে, তাঁর সময়ই পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৭০০ জনে।
তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র এই পত্রিকাটি প্রথমে মূলত জন্ম নিয়েছিল সভ্যদের মধ্যে সভার প্রচলিত কাজ ও বিবরণ প্রচারের উদ্দেশ্যে-
 “তত্ত্ববোধিনী সভার অনেক সভ্য পরস্পর দূর দূর স্থায়ী প্রযুক্ত সভার সমুদয় উপস্থিত কার্য্য সর্ব্বদা জ্ঞাত হইতে পারেন না, সুতরাং ব্রহ্মজ্ঞানের অনুশীলনা এবং উন্নতি কিপ্রকারে হইবেক? অত্রএব তাহারদিগের এসকল বিষয়ের অবগতির জন্য এই পত্রিকাতে সভার প্রচলিত কার্য্য  বিষয়ক বিবরণ  প্রচার হইবেক”।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এসিয়াটিক সোসাইটির পেপার কমিটির মতো এখানেও একটি প্রবন্ধ নির্বাচনী কমিটি তৈরি করেন। নকুড়চন্দ্র বিশ্বাস তাঁর বিবরণে জানান, পাঁচজনের এই কমিটিতে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,  রাজেন্দ্রলাল মিত্র, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, আনন্দকৃষ্ণ বসু। তবে শুরুতে বোধহয় কেউ কেউ ছিলেন না। মুহম্মদ সাইফুল ইসলামের মতে, প্রথম বারের পাঁচ জন হলেন শ্রীধর বিদ্যারত্ন, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, আনন্দকৃষ্ণ বসু ও শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। “… ১৭৭০ শকের ২৩-এ শ্রাবণ তারিখের অধ্যক্ষ সভার অধিবেশনে তিনি [অক্ষয়কুমার] পেপার কমিটির সভ্যশ্রেণী ভুক্ত হন”।
এ বিষয়ে একটি ঘটনা উল্লেখ করা জরুরি মনে করছি। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’  প্রকাশিত হয় ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার ও সভ্যদের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু একথাও ঠিক যে পত্রিকা প্রকাশের পরে তাঁরা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন।
    “২১.১২.১৮৪৩ খ্রী. তিনি (অক্ষয়কুমার) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অপর ১৯ জন বন্ধুর সঙ্গে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন। এই দলই প্রথম দীক্ষিত ব্রাহ্ম”। (সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান)

তিন
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যে উদ্দেশ্য নিয়ে পত্রিকা প্রকাশ ও অক্ষয়কুমারকে সম্পাদক নিযুক্ত করেছিলেন, তা পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হয়। অক্ষয় দত্ত ব্রাহ্ম হয়েও প্রার্থনার প্রয়োজন স্বীকার করতেন না। তিনি তর্কশাস্ত্রের ভঙ্গিতে প্রার্থনার অনাবশ্যকতা দেখিয়ে দেন-
    পরিশ্রম=শস্য
    প্রার্থনা+পরিশ্রম=শস্য
    প্রার্থনা=০
আমরা এই গভীর তর্কে প্রবেশ করবো না। শুধু একটি ঘটনা উল্লেখ করে মহর্ষির সঙ্গে  অক্ষয়কুমার দত্তের বিচ্ছেদ অনুমান করতে পারি মাত্র।

১৭৭৫ শকাব্দ, ৬ ভাদ্র রাজনারায়ণ বসু মেদিনীপুরে একটি বক্তৃতা দেন। বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার এই বক্তৃতাটি পত্রিকায় প্রকাশযোগ্য মনে করেননি। অক্ষয়কুমার দত্ত আরও একধাপ এগিয়ে বক্তৃতাটিকে অযোগ্য বলেন। ফলে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর প্রতি রুষ্ট হন। এর সঙ্গে ছিল অক্ষয়কুমারের বস্তুবাদী মন। সব মিলিয়ে তাঁকে একসময় সম্পাদক পদ হারাতে হয়। (তথ্যসূত্র: মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম,  কোরক সংকলন)
আর এখানে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে দুজনের পরিচয় পর্বের মুহূর্তটিতে। ঈশ্বর গুপ্ত মহর্ষির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দে তরুণ অক্ষয়কুমার দত্তের। বিস্ময়ের বিষয় এই যে অনেকসময়ই অক্ষয়কুমারের কথা/লেখার সঙ্গে কাজের মিল থাকত না। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সে তথ্যই তুলে দিয়েছেন ‘বাংলা সাহিত্যের  ইতিবৃত্তে’-
    “.....দেবেন্দ্রনাথ গৃহীত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অক্ষয়কুমার সন্ন্যাসজীবনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন--- উত্তরকালে যার সঙ্গে তাঁর কিছুমাত্র ঐকমত্য ছিল না”।

এই স্বপ্নভঙ্গই কি দুজনের সম্পর্ক ভাঙার ক্ষেত্রে পরোক্ষে কাজ করেছে!

ছবি গুগ্‌ল থেকে সংগৃহীত


No comments:

Post a Comment

একটি লড়াকু পত্রিকা সম্পাদকমণ্ডলীঃ   অভিজিৎ   ঘোষ ,  অনির্বাণ সরকার ,  এয়োনিয়ান   অনির্বাণ ,  সুমিত পতি ,  মনোহর হোসেন ...