-->

কবিতাঃ স্নেহাংশু বিকাশ দাস






ভাঙচোরা বারান্দার আলো    

##
এক একটা সন্ধে সযত্নে কোলাহল এড়িয়ে চলে যায়। সাধ্যমতো চেষ্টা করে আরও আড়ালে যেতে। রূপকথা থেকে মধ্যরাতের চাঁদ যখন ঘরে ঢুকে পড়ে তখনই সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়িটা ঘড়ঘড় করে চলতে শুরু করে। তার চলার শব্দে হারমোনিয়ম জেগে ওঠে। পাহাড় থেকে পোয়াতি ঝর্না নেমে আসে। হৈ হৈ ঢুকে পড়ে ধুলোভর্তি ঘরে। অন্তরঙ্গ গানে জীবনের সব আড়াল সরে গেলে দেখতে পাওয়া যায় হরিণীর মোমত্বক। সেই ত্বকে চাঁদের আলো পড়ে। মেঘের ছায়া – গভীর আগ্রহ নিয়ে দক্ষিনের আকাশে এসে ফ্রেমবন্দি ঝুলতে থাকে। আশেপাশের বাড়িগুলোতে এখন অব্যর্থ শীত। তারা সুর থেকে কোলাহল থেকে বহুদূরে চলে গেছে। জ্যোৎস্নাভরা বেলপাহাড়ীর দিকে চলে গেছে। সেখানে সবুজের বিষাদসুর এখন। গড়িয়ে চলেছে অগাধ বিরহ নিয়ে। তখন হারমোনিয়ম বড়ো মিথ্যে লাগে। হতাশ লাগে।

##

দৌড় শুরু হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। মঞ্চের দিকে, নির্জন ফুলগাছের দিকে এই মনখারাপের দৌড়। সেই কবে একটা ফুলগাছ পুঁতেছিলাম। তাতে এখন কুঁড়ি এসেছে। ফুল যে কতো ম্যানার্স, এটিকেট শিখেছে! এখন দরজা খোলে, অভিমানও খুলে দেয় কখনও সখনও। আজকাল ফ্লাওয়ারভাসের জন্য ফুল কিনি না। ফুল শুকিয়ে গেলে কষ্ট হয়, খারাপ লাগে। এইসব খারাপলাগাগুলোকে ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করি। ওদের বলি সুদেষ্ণার কাছে চলে যেতে। সুদেষ্ণা ভালো কেক বানাতে পারে। সদ্যসদ্যই শিখেছে। ওর বানানো কেক-এ আছে মনখারাপের ওষুধ।
কখনও বৃষ্টির দিনে ওর কেক থেকে অনবরত বৃষ্টি ঝরে পড়ে। বুঝতে পারি মনখারাপ সংক্রামিত হয়েছে। বুঝতে পারি আকাশের সেদিন মুখভার, নিম্নচাপ। সেদিন যাদবপুর কফি হাউস ফাঁকাই থাকবে। কফি হাউসের নীচে আর ইন্দ্রনীলের বিড়ির ধোঁয়া ঢেউ তুলবে না আকাশে। আশা করা যায় পরের দিন আকাশ পরিস্কার হবে।

 ##

আমার দু’হাতে ছেঁড়াফাটা কিছু ক্রোধ। এছাড়া আমার অন্য কোনও অসুখ নেই। অবশ্য ভাঙনও একপ্রকার অসুখ। নিজের মধ্যেকার যে প্রতিনিয়ত ভাঙন তা ডানার ক্লান্তিতে মিশে রয়েছে। মৃত্যুর শোক আছে। শোকেরও পর্যাপ্ত জীবন আছে। স্রোতের গভীরে এই রকমফের জুড়ে দিয়েছে জীবনের ক্ষতগুলো। তাই এক ভাঙন থেকে আরেক ভাঙনের দিকে এই চলাচল বুদবুদ তোলে প্রাণের গভীরে। জুড়ে যায় পাখিভাষার সঙ্গে। পাখিরা যে কোনও অসুখেই মলম হয়ে আসে। যা মানুষ মেনে নিয়েছে। আজকাল ক্রোধও ফুরিয়ে আসছে। ভাগ্যরেখা জুড়ে এখন বেদনাসক্ত মাটি। সে মাটির বুকে নামিয়ে রেখেছি আমার ভিজে যাওয়া শরীর, পুরনো গিটার। সে গিটার বেজে ওঠে পাখিদের কিচিরমিচিরের ভেতর।


##

নীল সমুদ্র আমাকে টানে। আরও আরও জড়িয়ে নেয় জীবনের সঙ্গে। ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়া প্রিয় ফুলদানিকে জুড়ে দেয় সমুদ্রবাতাস। আমার ভেতরের দুঃখকষ্ট, হাহাকার সমুদ্রে আছড়ে পড়ে। ঢেউ আর ঢেউ। যেন প্রবল ইঙ্গিত, মিশে যাচ্ছে ভাষাবদলের আনন্দে। মিশে যাচ্ছে রাতের নোনামন্ত্রে। আমি চুপ করে থাকি। দেখি অভিমানী গাঙচিল উড়ে যায় কোনও নতুন বন্দরের দিকে। সমুদ্র বেজে উঠছে সঙ্গীতের মতো। লাজুক আকাশে তার সুর ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সুরে খুশির আমেজ। সমুদ্রসৈকতের সমস্ত বাবারা এক আকাশ বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দেবে তাদের সন্তানদের। আমি লুকিয়ে ফেলি আমার সকল বিষণ্ণতা। ওপরে নীল আকাশ, বুকের মধ্যে সোজাসাপটা বালি, হাওয়া, ঢেউ। এক আশ্চর্য পিলসুজ আলো বয়ে আনে। আলোর পালক। সে পালকে ভরে যায় সবুজ হাওয়া। ভরে ওঠে রাতের চৌকাঠ। রাতভর হোটেলের ব্যালকনিতে খেলা করে যৌনচাঁদ।

1 comment:

  1. এক আত্মপর্যটনের গভীর অন্বয় কবিতাগুলির শরীরে বিষাদ ও বাতায়ন লেপ্টে আছে। ব্যক্তি চেতনার নিবিড় সংযোগ থেকে প্রেমের এক মহা অনুকার বেজে ওঠে। "সে পালকে ভরে যায় সবুজ হাওয়া। ভরে ওঠে রাতের চৌকাঠ। রাতভর হোটেলের ব্যালকনিতে খেলা করে যৌনচাঁদ।"

    ReplyDelete

একটি লড়াকু পত্রিকা সম্পাদকমণ্ডলীঃ   অভিজিৎ   ঘোষ ,  অনির্বাণ সরকার ,  এয়োনিয়ান   অনির্বাণ ,  সুমিত পতি ,  মনোহর হোসেন ...