-->

গদ্য : বিধান রায়



সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরীঢোঁড়াই চরিত মানস’   
                     একটি পাঠক প্রতিক্রিয়া   
                                                               
ভারতীয় ইতিহাসের এক উত্তাল সময়ের প্রতিফলন ঘটেছে ‘জাগরী’ উপন্যাসে। একদিকে বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলন, অন্যদিকে সোভিয়েত আক্রান্ত হয় ফ্যাসিবাদী শক্তির দ্বারা। ১৯৪১-এ পাটনায় নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের সর্বভারতীয় সম্মেলন থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তার ‘জনযুদ্ধ’ নীতি ঘোষণা করে। এই যুদ্ধকে জনগনের যুদ্ধ বলা হয়। সোভিয়েতের প্রতি সংহতি ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার আহ্বান ছিল এই নীতির মূল উদ্দেশ্য। সোভিয়েতের প্রতি কংগ্রেসের সহানুভূতি থাকলেও তারা এই জনযুদ্ধ নীতিকে সমর্থন করেনি। সোস্যালিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক তো সরাসরি বিরোধিতা করে। জনযুদ্ধ নীতিকে  অনেক সাধারণ মানুষের মত সতীনাথও মেনে নিতে পারেননি। আর তারই প্রতিফলন ঘটেছে ‘জাগরী’ উপন্যাসে। উপন্যাসে গান্ধীবাদী বাবার বড় ছেলে বিলু কংগ্রেস সোস্যালিস্ট দলের, ছোটো ছেলে নীলু কমিউনিস্ট দলভুক্ত। নীলু মনে করে ব্রিটিশের বিপক্ষে যাওয়াটা পরোক্ষে ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করা। এ রকম মোটাদাগের না হলেও তখনকার দিনে অনেক বুদ্ধিজীবী মানুষের মনে এই ধরণা ছিলই। সতীনাথ খুব কৌশলে এই জায়গাটাকে ধরেছেন বলে মনে হয়। নিলু গোঁয়ার, জেদী,একরোখা স্বভাবের। নিজের দলের সিদ্ধান্ত মানে না অর্থাৎ ফ্যাসিবাদী চরিত্রের যে যে বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায় সেগুলির বেশ কিছুটা নীলুর মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিলু শান্ত স্বভাবের সহনশীল মনোবৃত্তির মানুষ। সে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট। 

লেখকের বিশ্বাসের প্রতিফলন উপন্যাসে ঘটে থাকে। ডাঃ বীরেন ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণা থেকে জানতে পারি সতীনাথ মার্ক্সবাদ, গান্ধীবাদ, র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করতে পারতেন। তিনি আরও বলেন,সতীনাথ প্রথমিক জীবনে মানবেন্দ্র রায়ের র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট পার্টির সংস্পর্শে এসেছিলেন। এ তথ্যকে মেনে নিয়েও আমাদের মনে হয় কংগ্রেস সোস্যালিস্টদের মার্ক্সবাদ সম্পর্কে উৎসাহ ছিল,বিপ্লবী কর্মপদ্ধতির নানান দিকও তাঁঁরা রপ্ত করেছিলেন, যেমন কমরেড বলা, লাল টুপি পরা ইত্যাদি। কিন্তু তাঁঁদের কর্মী নেতৃ্ত্বের একটা অংশের মার্ক্সবাদ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। যেমন বিলু বলেছেআমার যদি টাকা থাকিত,তাহা হইলে আজ উইল করিয়া যাইতাম অনেক কোটি টাকাতাহা দিয়া মার্ক্সবাদের প্রচারকার্য চলিত...কিন্তু টাকা আসিবে কোথা হইতে? যদি লটারীর টিকিট না কিনিয়া লটারীতে টাকা পাইবার সুবিধা থাকিত”প্রসঙ্গটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যদি তৎকালীন যুগের কোনো কমিউনিস্টের কোনোরকম দ্বিচারিতা লক্ষ্য করে এরকম মন্তব্য না করা হয়,তাহলে ভাগ্যের টাকায় বস্তুবাদের প্রচার(?) অথবা টাকার অভাবে মার্ক্সবাদের প্রচারকার্য আটকে থাকা,এমন ভাবনা মার্ক্সবাদ সম্পর্কে এক প্রকার অস্পষ্টতা। প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় সতীনাথ বলেছেন, কোনো রাজনৈ্তিক দল বা মতবাদকে আক্রমণ করা ‘জাগরী’র উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু এই নিরপেক্ষতা সতীনাথ শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পেরেছিলেন কী ? এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। তৎকালীন রাজনৈ্তিক কর্মকাণ্ডে ‘ভালো’র উপস্থিতিকে তিনি বোধহয় দেখতে পাননি। মার্ক্সবাদ ভালো কিন্তু ওই মতবাদের প্রয়োগকর্তারা ভালো নন। যেমন নীলু। গান্ধীবাদ ভালো কিন্তু প্রয়োগকর্তারা ভালো নন। যেমন, কপিল দেও সিং, সহদেও সিং, বচ্চন সিং, লাডলী বাবুরা। অর্থাৎ ভারতীয় রাজনীতির প্রক্ষাপটে গান্ধীবাদ -মার্ক্সবাদ উপযুক্ত নেতৃ্ত্বের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং তার ভুল প্রয়োগে সমাজে ভুল বার্তা যাচ্ছে। সতীনাথ টানটান উত্তেজনাময় কাহিনিপটে এইভাবেই একটা সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করেছেন। কাহিনির মধ্যে নীলুর দাদার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার ঘটনাটাই মুখ্য। সেই ঘটনার সূত্রেই যাবতীয় রাজনৈ্তিক দুর্ভোগ সহ্য করেছে একটি পরিবার। আবার দাদার ফাঁসি না হওয়ার কথা জানতে পেরে নীলুর ধমনীতে স্পন্দন আরম্ভ হয়েছে, পৃ্থিবীকে লাস্যময়ী ছন্দে লীলায়িত বলেই মনে হয়েছে। আগাগোড়া চরিত্রগুলিতে রাজনৈতিক সংঘাত, দুর্ভোগ আছে,কিন্তু রাজনৈ্তিক সমাপন নাই, আছে পারিবারিক ক্যাথারসিস। সতীনাথ ভাদুড়ী ভারতীয় চিরায়ত সংস্কৃতিকে আধার করতে চেয়েছেন, আর যৌথপরিবার, সৌভ্রাত্বকে করেছেন আধেয়। রাজনীতিকে মনে করেছেন আকস্মিক ঝটিকামাত্র। এই ঝটিকা থেকে আধার দিয়ে আধেয়কে আগলে রাখতে চেয়েছেন।  

                                       ২
বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক গোপাল হালদার বলেছেন –“যদি কোনো একটিমাত্র বই থেকে সতীনাথ ভাদুড়ী মানুষটিকে চিনতে  হত – আমি হয়তো ‘জাগরী’ ছেড়ে ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ কে উল্লেখ করতাম। শান্তরসে স্বচ্ছন্দ প্রকাশ”। সতীনাথ ভাদুড়ী সহানুভূতির সঙ্গে ঢোঁড়াই চরিত্রকে প্রস্ফুটিত করেছেন। “তাৎমাটুলিতে ঢোড়াই নামে এক লোক সত্যিই ছিল। সে একবছর আগে স্বর্গে গিয়েছে। তবে তার  হিন্দিতে বানান ঢোঢ়াই, উচ্চারণ ঢোড়াহাই। বাঙালিরা নিজের ধরনে করে নিয়েছে ঢোঁড়াই (প্রবন্ধ, ঢোঁড়াই,সতীনাথ গ্রন্থাবলী ২য় খণ্ড) তুলসিদাসের রামচরিতের বিশালতায় ধরতে চেয়েছেন ঢোঁড়াইদের জীবনযাত্রাকে। ঢোঁড়াই সেই বিশাল কাহিনির মধ্যমণি।  আজন্ম বঞ্চিত শিকড়হীন একজন মানুষকে উপন্যাসের সুবিশাল বক্ষপটে ধরতে চেয়েছেন। রাজনৈতিক জাগৃতির সঙ্গে সঙ্গে সংঘাত যেমন অবশ্যম্ভাবী,যে সংঘাত পারিবারিক ভিত্তিকে নাড়া দেয়, যার কাহিনি ধরা আছে জাগরীতে তেমনি সমাজনীতির সংঘাতও অনিবার্য। সমাজনীতির যা কিছু স্থাবর রক্ষণশীল ,তার সঙ্গেই ছিল ঢোঁড়াইয়ের বিদ্রোহ। সঙ্গে ছিল কনিষ্ঠ ছেলের দল। ঢোঁড়াই সমাজবিধি ভেঙে ‘পাক্কী’ (কোশী শিলিগুড়ি রোড) তে কাজ নেয়, যজ্ঞের পৈতে গ্রহণ করে, অন্যদিকে হ্রাস পাচ্ছে পঞ্চায়েতের ক্ষমতা, মাহাতো নির্জীব হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, তাৎমাটুলি থেকে লোক চলে যাচ্ছে, রতুয়ার বোন চলে যাচ্ছে মুসলমানের সঙ্গে,হারিয়া মেয়েটার বিয়ে দিয়ে আসছে মালদা জেলায় টাকার লোভে,মাহাতোর নিজের ছেলে বালি ছাঁকার কাজ ছেড়ে রাজমিস্ত্রিদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে পঞ্চায়েতী টাকার হিসাব চাইছে গাঁয়ের লোক। "...মাহাতো থৈ পায় না"। এটাই সমাজ জাগৃতি। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যা অবশ্যম্ভাবী সমাজবদ্ধতা থেকে সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে ইনডিভিজুয়ালিটির দিকে আর এই ইনডিভইজুয়ালিটির নায়ক ঢোঁড়াই স্থাবর সমাজ কী সংঘাত ছাড়াই এই সমাজ-জাগৃতিকে মেনে নিচ্ছে? না। প্রতিঘাতে প্রস্তুত হচ্ছে সেই স্থাবর সমাজ। রামিয়াকে ঢোঁড়াইয়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তুলে দিচ্ছে স্যামুয়েলের হাতে গ্রামের পঞ্চ বা মাহাতোরা। সমাজ রাজনীতি কীভাবে ইনডিভিজুয়ালিটিকে আঘাত করে তা এই অংশে ধরা পড়েছে। ঢোঁড়াইয়ের কাছে দুটো জিনিস সত্য পাক্কী আর রামায়ণ। জীবন হোক সহজ সরল পাক্কীটার মত। রামায়ণের মতো পবিত্র, রামরাজ্যের বাসিন্দা হোক সমাজমানুষ। কিন্তু পরবর্তীকালের রাজনৈতিক সংঘাত স্বার্থপরতা ঢোঁড়াইয়ের স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। বিস্কিন্দায় এসে জমির সঙ্গে পরিচয় হয় ঢোঁড়াইয়ের। কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষের সঙ্গে সামাজিক পরিচয় স্থাপিত হয় তার। বড় জনগোষ্ঠীর স্বার্থে বাবুসাব বচ্চন সিং -এর সাথে বিরোধ বাঁঁধে। লাডলীবাবু অনেকটা ‘জাগরী’র সহদেও সিং -এর -মতো। বচ্চন সিং -এর আখের গোছানোর নেপথ্যের কল আর প্রকাশ্যে গান্ধীবাদী নেতা। ঢোঁঁড়াইয়ের বিশ্বাসভঙ্গ হয়। ভলেনটিয়াররা রিলিফের চাঁদা নিয়ে চলে যায়। অনুরূপ একই বিষয় সে লক্ষ করে ক্রান্তিদলেও। আজাদদস্তায় হয়ে যায় রামায়ণজি। আশ্রয় নেয় রামায়ণে। কিন্তু “যখনই ঢোড়াইয়ের জীবনটা চলনসই গোছের হয়ে আসে, অমনি একটা করে আঁধি উঠে সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায়’। একজন শিকড়হীন মানুষ যে ছোটবেলা থেকে বাবা মার স্নেহ হতে বঞ্চিত আশ্রয় পায় আর এক আশ্রয়হীন বৌকাবাওয়ার কাছে। সেই মানুষ একটা পরিচয় চায় একটু মাটি চায়। কোথাও সে সে রকম আশ্রয় পায়নি। না তাৎমাটুলি না জিরানিয়া না বিষকিন্দায়। তাই সে আশ্রয় চেয়েছিল রাজনীতির কাছে। কিন্তু সেখানেও তার শুভবোধ আপস করতে পারেনি অসততার সঙ্গে। অবশেষে এ্যান্টনিকে ঘিরে দেখেছিল স্থায়ী কোনো ঠিকানার স্বপ্ন। তাও ভেঙে গেছে। বারবার স্বপ্নভঙ্গের এই বিপ্লবী শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পন করেছে পরদেশী শাসনযত্রের কাছে। এই মানুষটা উদ্বাস্তু কিন্তু উৎপাদনমুখী। তাই ঢোড়াই চরিত মানস এক উৎপাদনমুখী উদ্বাস্তুর কাহিনি। এখানে রাজনীতি ঢোঁড়াইয়ের রামিয়ার মত যে ঢোঁড়াইয়ের সাথে প্রতারণা করেছে। রামিয়া যেমন মৃত সন্তান প্রসব করেছে তেমনই ভারতীয় রাজনীতি ঢোঁড়াইদের মত মানুষের কাছে পরবর্তী পুরুষকে রেখে যায়নি।

*ছবি গুগল থেকে সংগৃহীত

No comments:

Post a Comment

একটি লড়াকু পত্রিকা সম্পাদকমণ্ডলীঃ   অভিজিৎ   ঘোষ ,  অনির্বাণ সরকার ,  এয়োনিয়ান   অনির্বাণ ,  সুমিত পতি ,  মনোহর হোসেন ...